শূন্য,শূন্য এবং শূন্যর পর মারভান আতাপাত্তুর রুদ্রমূর্তি

ব্যর্থতার পর বারবার চেষ্টার মাধ্যমে সফল হওয়ার গল্প তো আমরা অনেক শুনেছি। কিন্তু,কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এত ভয়াবহভাবে জেঁকে ধরে যে,এটি থেকে বেরিয়ে এসে সফল হওয়ার ঘটনাগুলো স্রেফ অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। মারভান আতাপাত্তুর গল্পটাও ঠিক সেরকম। 


মারভান আতাপাত্তু। নামটির সাথে আমরা বেশিরভাগই পরিচিত। শ্রীলংকার তারকা একজন ক্রিকেটার হিসেবে তার নাম-ডাক বেশ। কিন্তু, এই আতাপাত্তুর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাত্রাটি ছিল ভয়াবহ রকম ব্যর্থতা দিয়ে শুরু।

একজন ক্রিকেটারের অভিষেকটা খারাপ হতেই পারে। কিন্তু,আতাপাত্তুর অভিষেকটা খারাপ তো হয়েছিলই,কিন্তু সেই ‘খারাপ’কে তিনি এতটাই ধারাবাহিক করে ফেলেছিলেন যে সেটি একেবারে শিল্পের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।


মারভান আতাপাত্তুর অভিষেকটা হয়েছিল ভারতের সাথে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে। সেই টেস্টে শুধু প্রথম ইনিংসেই ‘০’ করেননি,বরং পরের ইনিংসেও ‘০’ রান করে এক টেস্ট ম্যাচের দুই ইনিংসেই ‘০’ রান করার মত লজ্জার ঘটনার জন্ম দেন তিনি। ফলে,অতি স্বাভাবিকভাবেই টেস্ট দল থেকে বাদ পড়েন তিনি।


তিনি নেট সেশনে নিজেকে প্রচুর সময় দেয়া শুরু করলেন। নিজের ভুল শুধরে নেয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে লাগলেন। ফল হিসেবে ঘরোয়া ক্রিকেটের ফার্স্ট-ক্লাস ম্যাচগুলোতে রানের বন্যা বইয়ে দিতে লাগলেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন আরেকটি ডাক এর।

অবশেষে ২১ মাস পর অর্থাৎ প্রায় ২ বছর পর তিনি আবার ডাক পেলেন টেস্ট দলে। এবার, দুই ইনিংসে তার রান ছিল যথাক্রমে ‘০’ ও ‘১’! ফলে বাদ পড়া তো অবশ্যম্ভাবীই ছিল,তাকে ভবিষ্যতে আর টেস্ট দলের জন্য বিবেচনা করা হবে কিনা,সে নিয়েই বিস্তর সমালোচনার ঝড় উঠল। মারভান আতাপাত্তু আবার ফিরে গেলেন নেট সেশনে আর ঘরোয়াতে।


আবার তিনি ঘরোয়াতে রানের তুবড়ি ফোটালেন। রানবন্যায় ভাসাতে লাগলেন বোলারদের। তারপরও যেন তিনি তার ব্যর্থতার প্রবল যন্ত্রণা ভুলতে পারছিলেন না। তিনি এতটাই দূর্দান্ত পারফর্ম করলেন যে,টানা দুইবার চূড়ান্ত ব্যর্থ হওয়ার পরও নির্বাচকরা একপ্রকার বাধ্য হলেন তাকে আবার টেস্ট দলে ফেরাতে। এবার প্রায় ১৭ মাস পর তিনি আবার ঢুকলেন টেস্ট দলে।


কি ভাবছেন? এবার তিনি সবকিছু পেছনে ফেলে ঘুরে দাঁড়ালেন? তা তো হয়ই নি,বরঞ্চ তিনি শুরুটা যেভাবে ‘ডাবল ০’ দিয়ে করেছিলেন,এবারও তিনি হুবুহু সেটাই ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। দুই ইনিংসেই করলেন ‘০’! এই কান্ডের পর আতাপাত্তুকে আজীবন টেস্ট দল থেকে বহিষ্কারের দাবি তুলল বিক্ষুব্ধ সমর্থকরা। নির্বাচকরা হয়ে পড়লেন বাকরুদ্ধ।

ফলে ভবিষ্যতে আতাপাত্তুকে আর কোনদিন টেস্ট দলের আশেপাশেও ঘেঁষতে দেয়া হবেনা,সেটা যেন একপ্রকার নিশ্চিতই হয়ে গিয়েছিল সকল মহল থেকে।

একজন ক্রিকেটারের একবার ভুল হতে পারে,দু’বারও ভুল হতে পারে,কিন্তু টানা পরপর তিনবার একইভাবে ব্যর্থ হওয়া,সেই ক্রিকেটারের অযোগ্যতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আতাপাত্তুর বিষয়ে নির্বাচকদের বক্তব্য ছিল,তার বড় ম্যাচ খেলার টেম্পারমেন্টই নেই। সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার মত টেকনিকটাই আয়ত্বে নেই তার।

আর আতাপাত্তু নিজেই যেন এক গভীর হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। এত এত কঠোর পরিশ্রম আর চেষ্টার পরও ন্যুনতম সাফল্য না আসায় তিনি মানসিকভাবে হয়ে পড়েন প্রচন্ড বিপর্যস্ত।

এই ভয়াবহ দুঃসহ স্মৃতির যন্ত্রণা ও শোক কিছুটা কমলে তিনি ঠিক করলেন,আর কোন প্রত্যাশা না। যতদিন খেলবেন নিজের কঠোর পরিশ্রম ও চেষ্টার ওপর বিশ্বাস রেখেই খেলে যাবেন,রান করে যাবেন। তাতে টেস্ট দলে তার ডাক আসুক আর না আসুক। জেদ চেপে গেল তার ভেতর। সেই জেদ ঝাড়লেন ঘরোয়াতে। আবারও সেই রানবন্যা।

আরও পড়ুন: জাতীয় দলে আরেকটি সুযোগের অপেক্ষায় মোহাম্মদ মিঠুন


এরপর ৩ বছর পর টেস্ট দলে আবার ডাক পাওয়াটাকে বোধহয় ভাগ্যের খেল বললে মোটেও ভুল হবেনা। কেননা টেস্ট দলে তার অতীত ইতিহাস তো রীতিমতো আঁতকে ওঠার মত। মারভান আতাপাত্তু আবার টেস্ট দলের জার্সি চাপিয়ে নামলেন। “ব্যর্থতার ষোলকলা” পূর্ণ করা সেই মারভান আতাপাত্তু! এবারও কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে? আরেকবার চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়ে কি তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠোকা হয়ে যাবে?

আতাপাত্তু যেন এবার ভাগ্য ও ইতিহাসের বিরুদ্ধেই অসম লড়াইয়ে নামলেন। তিনি ঠিক করলেন,তার তো আর হারাবার কিছুই নেই,কিছু ছিলও না। যতটুকুই করবেন,ততটুকুই অর্জন। খারাপের সর্বনিন্ম স্তরের অভিজ্ঞতা দিয়ে তো তার ঝুলি পূর্ণই। এবার হয় এসপার,না হয় ওসপার। সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে একেবারে ঠান্ডা মাথায় নেমে পড়লেন ব্যাটিংয়ে।


সেই ম্যাচে কত করলেন,তা আর জানার ইচ্ছা থাকবে না,যদি আতাপাত্তুর টেস্ট ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যানটিতে একবার চোখে বুলিয়ে নেন। সেই ম্যাচে যে শুরু করলেন রান করা,টেস্ট ক্যারিয়ার শেষে আতাপাত্তুর নামের পাশে জ্বলজ্বল করতে লাগল ১৬ টি সেঞ্চুরি ও ৬ টি ডাবল সেঞ্চুরি! রীতিমতো অনবদ্য,অদম্য,বিস্ময়কর,দূর্দান্ত! কোন শব্দই যে যথেষ্ট না এটি ব্যাখ্যা করতে। যেই আতাপাত্তুকে টেস্ট দল থেকে আজীবন বহিষ্কারের দাবি তুলেছিল সমর্থকরা,সেই আতাপাত্তুই দেশকে নেতৃত্বের দায়িত্ব পেলেন।


ব্যর্থতাকে জয় করে সাফল্য লাভের ঘটনার উদাহরণের অভাব নেই আমাদের চারপাশে। কিন্তু,কঠোর পরিশ্রম ও চেষ্টার পরও শুধুমাত্র ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারণে যখন কেউ বারবার ব্যর্থ হতে থাকে,তখন কোন অনুপ্রেরণাই আর কাজে আসেনা। শেষমেশ অসহায় আত্নসমর্পণ করতে হয় ব্যর্থতার কাছে। কিন্তু,আতাপাত্তু বোধহয় সেই ভাগ্যকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একপ্রকার জোর করেই ছিনিয়ে এনেছিলেন সাফল্য। ভাগ্যও যেন শেষপর্যন্ত নিতান্ত আত্নসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল আতাপাত্তুর কাছে!

লিখেছেন: মিরাজ মাহবুব

Leave a Comment