“যুবরাজ সিং”,নামটা শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে স্টুয়ার্ট ব্রডের করা এক ওভারের ছয়টি বলকেই পিটিয়ে গ্যালারিতে পাঠানো এক রাজার চেহারা। তবে,সারাটি জীবন ধরেই তিনি যেসব অসাধ্যকে জয় করে এসেছেন,সেগুলোর তুলনায় এই ঘটনাটি অতি নস্যিই বটে। নামের মতই কাজের ছাপ রেখেছেন জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে।
ঘটনাটি ২০১১ বিশ্বকাপের ঠিক আগে সাউথ আফ্রিকার সাথে একটি ওয়ানডে ম্যাচের। পুরো ম্যাচ জুড়েই একটা অস্বস্তি কাজ করছিল,মোটেই ভাল বোধ করছিলেন না। তবুও সেটিকে পাত্তা ন দিয়ে ম্যাচটা খেলেছেন শতভাগ দিয়ে। রানিং বিটুইন দ্যা উইকেটে কষ্ট হচ্ছিল অসহ্য। তবু খেলাটা চালিয়ে গেছেন। ম্যাচ শেষে হোটেলে এসেই ছুটলেন ওয়াশরুমের বেসিনের দিকে। প্রবল কাশির সঙ্গে বেসিনে পড়ল একগাদা রক্ত। তিনি বুঝতে পারলেন,অশনিসংকেত!
কিন্তু সামনেই যে বিশ্বকাপ। বহু ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন,লড়াই করবেন। এরপর বিশ্বকাপ খেললেন,বিশ্বকাপ জিতলেন,হলেন টূর্ণামেন্ট সেরা খেলোয়াড়ও। কিন্তু,কেউই জানতে পারল না কি ভয়াবহ এক রোগ চেপে গিয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন তিনি। তবে তারপরই শুনতে হল,ক্যান্সারে আক্রান্ত তিনি! ভাবছেন সব শেষ হয়ে গেল? তা কি করে সম্ভব? নামটা যে যুবরাজ সিংহ! এই রাজা শেষপর্যন্ত মরণপণ লড়াই করে ক্যান্সারকেও বলের মত গ্যালারিছাড়া করলেন!
পুরো নাম “যুবরাজ সিং”। তবে ছোট্ট করে সকলে ডাকে “যুবি” বলে। নামের মতই রাজ করেছেন সর্বত্র। যখন যেখানেই খেলতে নেমেছেন,খেলেছেন রাজার মতই। প্রতিপক্ষকে শাসন করেছেন শক্ত হাতে। মূলত ব্যাটসম্যান হিসেবে শুরু করলেও করতেন অফ স্পিন বোলিংটাও। “বিগ পাওয়ার হিটিং” ছিল ব্যাটিংয়ের মূল শক্তি।
মুড়ি মুড়কির মত পিটিয়ে বলকে পাঠাতে পারতেন গ্যালারিতে। বোলারদের জন্য ছিলেন রীতিমতো এক মূর্তিমান আতঙ্ক। যার আঁচটা বোধহয় সবচেয়ে বেশি টের পেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রড। গুণে গুণে ওভারের ছয়টি বলই যুবরাজ আতশবাজির মত আছড়ে ফেলেছিলেন গ্যালারিতে। দূর্দান্ত বোলার ব্রডের অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিচ্ছুটি করার ছিল না। এমনই মারদাঙ্গা চরিত্র ছিলেন যুবরাজ।
আর বোলিংয়ে তো যুবরাজকে বিশ্ব চিনত অন্যতম সেরা “গোল্ডেন আর্মার” হিসেবে। অফ স্পিন বোলিংয়ে বহু সময়ে তুলে নিয়েছেন প্রতিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ উইকেট। “প্রতিপক্ষের উইকেট ফেলতে পারছ না? মূল বোলাররা ব্যর্থ? তাহলে যুবরাজকে বোলিংয়ে আনো”- এটাই যেন ছিল ভারতের অধিনায়কদের কাছে অমোঘ এক সূত্র। পার্ট টাইমার থেকে এক পর্যায়ে হয়ে উঠলেন প্রায় নিয়মিত বোলার। সুতরাং,”পারফেক্ট অলরাউন্ডার” এর একটা আলাদা উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যুবরাজ সিং।
তবে এমন রুদ্রমূর্তির মত আক্রমণাত্মক চরিত্র এমনি এমনিই আসেনি তার ভেতর। তার জন্ম যে ভারতের চণ্ডীগড়ের এক শিখ পরিবারে। যেটি কিনা শক্তিশালী চোয়ালবদ্ধ জোয়ানদের আঁতুড়ঘর। ছোটবেলা থেকেই সেখানকার ছেলেপেলেদের সেভাবেই বেড়ে ওঠা। যুবরাজ সিংহ এর পিতা যোগরাজ সিং নিজেও ছিলেন ভারত জাতীয় দলের একজন ক্রিকেটার। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মাত্র ৭টি ম্যাচেই জাতীয় দলের পাঠ চুকাতে হয়েছিল তাকে।
আরও পড়ুন: শূন্য,শূন্য এবং শূন্যর পর মারভান আতাপাত্তুর রুদ্রমূর্তি
এটাই যেন তার ভেতর রোখ চাপিয়ে দিয়েছিল। যে করেই হোক ছেলেকে দিয়ে অতৃপ্ত স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাবেন। ব্যাস! ছেলে যুবরাজের কি আর অন্য কোন উপায় থাকতে পারে? পিতার কঠোর নির্দেশনায় গড়ে তোলা হচ্ছিল ক্রিকেটার যুবরাজকে। এজন্য পড়াশোনাসহ আরো অনেককিছুই বিসর্জন দিতে হয়েছিল যুবরাজ সিং কে । তবু শত হলেও তো পিতার রক্তই বইছিল তার শরীরে। তারও একসময় রোখ চেপে গেল। যে করেই হোক পিতা যোগরাজ সিং যেখানে শেষ করেছিলেন,সেখান থেকেই শুরু করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে অসীম উচ্চতায়।
বয়সভিত্তিক দল,রাজ্য দল,ঘরোয়া টুর্নামেন্ট,আইপিএল ও জাতীয় দল- যেখানেই খেলতে নেমেছেন,রানবন্যার তুবড়ি ছুটিয়েছেন। টপাটপ তুলে নিয়েছেন প্রতিপক্ষের উইকেট। আর ফিল্ডার যুবরাজের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ না করলে তার নামের প্রতি বড্ড অবিচার করা হবে। স্লিপ কর্ডনে যুবরাজ সিংহ দাঁড়ানো মানেই প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানের জন্য ওই অঞ্চল পুরোপুরি বন্ধ। উড়িয়ে কিংবা মাটি ঘেঁষে-যেভাবেই মারো না কেন,সবই গিয়ে তালুবন্দি হবে যুবির হাতে। ফসকানোর কোন সুযোগই নেই। ব্যাটিং-বোলিংয়ে যেদিন ব্যর্থ হতেন তিনি,সেদিন সব পুষিয়ে দিতেন অনবদ্য ফিল্ডিং দিয়ে।
যুবরাজের কাঁধে চড়েই ২৮ বছর পর ওয়ানডে বিশ্বকাপের স্বাদ পেয়েছিল ভারত। তাও আবার ঘরের মাটিতে। পুরো টূর্ণামেন্টে ৮ ম্যাচে ৩৬২ রান ও ১৫ উইকেট শিকার করে হয়েছিলেন সেরা খেলোয়াড়। অথচ কেউ ক্ষুণাক্ষরেও জানতে পারেনি কি ভয়াবহ যন্ত্রণা সঙ্গী করে প্রতিটি মূহুর্ত কাটাতে হয়েছিল তাকে। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট,বুকব্যথা আর রক্তবমিতে কাটাতে হত প্রতিটি মূহুর্ত! বিশ্বকাপ শেষে যখন তার ক্যান্সার ধরা পড়েছিল,তখন সবাই ধরে নিয়েছিল-এইই বোধহয় শেষ হল যুবরাজ অধ্যায়।
কিন্তু যুবরাজ সিং জানতেন,তাকে এই অসম্ভব কঠিন যুদ্ধ যে করেই হোক জিততেই হবে। তার শিরায় যে বইছে টগবগে লড়াকু রক্ত। দীর্ঘ ছয় ছয়টি মাস মরণপণ লড়াই শেষে পরাজিত করলেন মরণব্যাধি ক্যান্সারকে। নিজ প্রতিজ্ঞায় অনড় থেকে কথা রাখলেন। ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইয়ের সময়ই ঠিক করে নিয়েছিলেন,যদি একবার জয়ী হতে পারেন,তবে আবার ওই নীল জার্সিটা গায়ে চড়িয়ে মাঠে নামবেন। তিনি কথা রেখেছিলেন। ২০১২ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মধ্য দিয়ে পুণর্জন্ম হয়েছিল যুবরাজ সিংয়ের। কেননা এই যুবরাজ যে হারতে জানে না,জানে কেবল রাজ করতে!